তেজস্ক্রিয় দূষণ

তেজস্ক্রিয় দূষণ – পাঠটি “পরিবেশ অধ্যয়ন বা এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ (Environmental Studies)” বিষয়ের “বিশ্বব্যাপী পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ ” অধ্যায়ের একটি পাঠ।

তেজস্ক্রিয় দূষণ

প্রাকৃতিক তেজষ্ক্রিয় পদার্থের (প্রকৃতিতে প্রাপ্ত) অসতর্ক ব্যবহার এবং প্রক্রিয়াকরণ ও কৃত্রিম উপায়ে তেজস্ক্রিয় পদার্থের অসতর্ক উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ এবং ব্যবহারের সময় তেজষ্ক্রিয় রশ্মির বিকিরণজনিত কারণে পরিবেশের যে অনভিপ্রেত পরিবর্তন ঘটে, তাকে ‘তেজষ্ক্রিয় দূষণ’ (Radioactive Pollution) বলা হয় ।

 

তেজস্ক্রিয় দূষণের উৎস (Sources of radioctive pollution) :

প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যসৃষ্ট উভয় উৎসই তেজষ্ক্রিয় দূষণের জন্য দায়ী । বিভিন্ন প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যসৃষ্ট উৎস এবং তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণকারী তেজস্ক্রিয় পদার্থের নাম তালিকায় উল্লেখ করা হলো:

 

তেজস্ক্রিয় দূষণ | বিশ্বব্যাপী পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ | পরিবেশ অধ্যয়ন

 

তেজস্ক্রিয় দূষণের কারণ (Causes of radioactive pollution) :

প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যসৃষ্ট কারণে উৎপন্ন তেজষ্ক্রিয় পদার্থের বিকিরণে পরিবেশ দূষিত হয়। প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যসৃষ্ট তেজষ্ক্রিয় দূষণের ঘটনা সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :

 

(ক) প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয় দূষণ :

(i) মহাশূন্য থেকে বায়ুমণ্ডলে প্রবেশকারী মহাজাগতিক রশ্মির (Cosmic ray) প্রভাবে স্বল্পায়ু তেজষ্ক্রিয় মৌল কার্বন-১৪ এবং ট্রাইটিয়াম (হাইড্রোজেন-৩) উৎপন্ন হয়। এই তেজস্ক্রিয় মৌলদ্বয় সরাসরি জীবজগতের উপর মন্দ প্রভাব সৃষ্টি করে। উৎপন্ন কার্বন-১৪ এবং হাইড্রোজেন-৩ অচিরেই কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং পানিতে জারিত হয়। উৎপন্ন কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং পানি বায়ুমণ্ডল এবং বারিমণ্ডলে প্রবেশ করে। মহাজাগতিক রশ্মির নিউট্রন’ কণার সঙ্গে বায়ুমণ্ডলের নাইট্রোজেন এর সংঘাতে কার্বন-১৪ এবং উচ্চ শক্তিসম্পন্ন মহাজাগতিক রশ্মি-কণার আঘাতে হাইড্রোজেন পরমাণুর বিয়োজনে হাইড্রোজেন-৩ বা ট্রাইটিয়াম উৎপন্ন হয় ।

(ii) পৃথিবীর ক্রাস্ট (ভূত্বক) অংশে বর্তমান ইউরেনিয়াম এবং থোরিয়ামের আকরিকই প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয় বিকিরণের প্রধান উৎস। প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয় পদার্থের তিনটি শ্রেণিক্রম রয়েছে, যারা প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তার জন্য দায়ী — (ক) ইউরেনিয়াম-রেডিয়াম ক্রম, (খ) থোরিয়াম ক্রম এবং (গ) ইউরেনিয়াম-অ্যাকটিনিয়াম ক্রম। এ ছাড়া পটাশিয়াম- ৪০ এবং রুবিডিয়াম-৪৭ তেজস্ক্রিয়তার জন্য বিশেষভাবে দায়ী। মৃত্তিকার ২০-৭৮ শতাংশ তেজস্ক্রিয়তা পটাশিয়াম-৪০ এর জন্য সৃষ্টি হয়।

(iii) বারিমণ্ডলও তেজষ্ক্রিয় পদার্থের দ্বারা দূষিত হতে পারে। যখন পানিস্রোত তেজস্ক্রিয় আকরিক বা যৌগসম্প্র মৃত্তিকা বা পাহাড়ের সংস্পর্শে প্রবাহিত হয়, তখন পানি তেজস্ক্রিয় পদার্থের দ্বারা দূষিত হয়। কিছু কিছু ঝরনা এবং প্রস্রবণে রেডন (নিষ্ক্রিয় গ্যাস) গ্যাসের তেজষ্ক্রিয় সমস্থানিক-“রেডন ২২২” এবং এর অপত্য সদস্য রেডিয়াম-A’ এবং রেডিয়াম C-এর উপস্থিতি প্রমাণিত হয়েছে।  এরূপে বায়ুমণ্ডল, অস্মমণ্ডল এবং বারিমণ্ডলে বর্তমান তেজস্ক্রিয় পদার্থের বিকিরণে পরিবেশের প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয় দূষণ সৃষ্টি হয়, যার প্রভাবে পরিবেশের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়।

 

(খ) মনুষ্যসৃষ্ট তেজষ্ক্রিয় দূষণ :

মনুষ্যসৃষ্ট তেজস্ক্রিয় পদার্থের ব্যবহারজনিত ক্রিয়াকলাপে তেজষ্ক্রিয় পদার্থের প্রক্রিয়াকরণ বা পারমাণবিক অস্ত্র এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেজস্ক্রিয় পদার্থের ব্যবহারই মনুষ্যসৃষ্ট তেজষ্ক্রিয় দূষণের প্রধান কারণ। এ ছাড়া গবেষণার কাজে বা চিকিৎসা প্রণালিতে ট্রেসার হিসেবে তেজষ্ক্রিয় পদার্থের ব্যবহারও মনুষ্যসৃষ্ট তেজস্ক্রিয় দূষণের কারণ ।

 

(i) তেজস্ক্রিয় আকরিকের প্রক্রিয়াকরণ  :

নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে বিয়োজনশীল তেজষ্ক্রিয় মৌল যথা ইউরেনিয়াম এবং থোরিয়ামের জ্বালানি দণ্ড ব্যবহার করা হয়। কিন্তু প্রাকৃতিক ইউরেনিয়াম ২৩৫-ই কেবল স্বতঃস্ফূর্ত বিয়োজন দেখাতে পারে। তাই নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টে ব্যবহারোপযোগী অন্যান্য তেজস্ক্রিয় সমস্থানিক যথা— ইউরেনিয়াম ২৩৮ এবং থোরিয়াম ২৩২ কৃত্রিম উপায়ে তেজষ্ক্রিয় মৌলের আকরিক থেকে প্রক্রিয়াকরণ করা হয়।

তাই নিউক্লিয়ার প্রক্রিয়াকরণ প্রযুক্তির প্রথম ধাপে তেজষ্ক্রিয় মৌলকে খনি থেকে উত্তোলন করার পর ধৌতকরণ (Washing) এবং পরিশোধন (Refining) করা হয় এবং পরবর্তী ধাপে গ্যাসীয় ব্যাপন বা অন্যান্য রাসায়নিক পদ্ধতির সাহায্যে ইউরেনিয়াম এবং থোরিয়ামের প্রয়োজনীয় সমস্থানিক অন্যান্য তেজষ্ক্রিয় মৌল থেকে পৃথক করা হয় । তেজস্ক্রিয় আকরিকের মাইনিং এবং রিফাইনিং প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত পানিতে অধিক অর্ধায়ুযুক্ত এবং জলে দ্রাব্য তেজস্ক্রিয় মৌল-‘কণা বা তরল’ আকারে উপস্থিত থাকে। নির্গত জল নদী, হ্রদ এবং সমুদ্রে স্থানান্তরিত হলে নদী, সমুদ্র এবং হ্রদের জলরাশি তেজষ্ক্রিয় পদার্থের দ্বারা দূষিত হয়।

ফলে তেজস্ক্রিয় পদার্থ নির্গত তেজস্ক্রিয় বিকিরণের প্রভাবে পানির সমগ্র বাস্তুতন্ত্র আক্রান্ত হয়। মাইনিং এবং রিফাইনিং নির্গত পানিতে ইউরেনিয়াম এবং থোরিয়ামের অপত্য মৌল যথা- থোরিয়াম ২৩০ রেডিয়াম ২২৬ সিসা ২১০ (ইউরেনিয়াম-রেডিয়ামের ক্রম) এবং রেডিয়াম-২২৮, থোরিয়াম- ২২৮ (থোরিয়াম ক্রম) প্রভৃতি উপস্থিত থাকে। পানিতে সংক্রমিত রেডিয়াম ২২৬-ই জলজ পরিবেশে সর্বাপেক্ষা ক্ষতিকর।

তেজষ্ক্রিয় মৌলের প্রক্রিয়াকরণে বায়ুমণ্ডলও দূষিত হয়। তেজষ্ক্রিয় আকরিকের মাইনিং, ওয়াশিং, রিফাইনিং এবং সেপারেশনে বহু তেজষ্ক্রিয় গ্যাস যথা রেডন, থোরন প্রভৃতি বায়ুমণ্ডলে নিক্ষিপ্ত হয় এবং পরবর্তী ধাপে বিক্ষিপ্ত কণায় বিশোষিত হয়ে বায়ুমণ্ডলে ভেসে বেড়ায় । 

 

(ii) নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের পারমাণবিক শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন :

‘বিভাজন’ ( ফিশন) এবং সংযোজন (ফিউশন) নিউক্লিয়ার প্রযুক্তির ভূমিকা। কোন মৌলের পরমাণুর অন্তর্নিহিত শক্তিকে পারমাণবিক শক্তি বলে। বিশেষ ‘বিভাজন’ (Fission) এবং ‘সংযোজন’ (Fusion) নিউক্লিয়ার প্রযুক্তির সাহায্যে নির্গত পারমাণবিক শক্তিকে বিদ্যুৎশক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়।

মৌলের পরমাণুর ভারী নিউক্লিয়াস (অসংখ্য প্রোটন এবং নিউট্রন সমন্বিত) স্বাভাবিকভাবেই অস্থির । বিভাজন প্রক্রিয়ায় ভারী নিউক্লিয়াসকে বহিরাগত ‘নিউট্রন’ কণার দ্বারা আঘাত করলে ভারী নিউক্লিয়াসটি সমান দুটি নিউক্লিয়াসে বিভাজিত হয়। উৎপন্ন নিউক্লিয়াসদ্বয় ভারীজনিত নিউক্লিয়াস অপেক্ষা অধিক সুস্থির হয়।

এই নিউক্লিয় বিভাজনে উদ্ভূত বিপুল শক্তিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে লাগানো হয় নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টে। এই বিভাজন প্রক্রিয়ায় ভারী তেজষ্ক্রিয় মৌল যথা— ইউরেনিয়ামের সমস্থানিক ইউরেনিয়াম-২৩৫ ইউরেনিয়াম-২৩৮ এবং থোরিয়াম-২৩২ বিশেষ উপযোগী। ঠিক বিপরীত নীতি অবলম্বনে ‘সংযোজন’ প্রক্রিয়ায় মৌলের পরমাণুর হাল্কা নিউক্লিয়াসদ্বয়কে সংযোজন করালে একটি সুস্থির নিউক্লিয়াস পাওয়া যায়। নিউক্লিয়াসদ্বয়ের সংযোজনে উদ্ভূত শক্তিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। সংযোজন প্রক্রিয়ায় হাইড্রোজেনের সমস্থানিক ‘ডয়টেরিয়াম’ (Deuterium, Hydrogen-2) এবং ট্রাইটিয়াম (Tritium, Hydrogen-3) ব্যবহার করা হয় ।

 

google news
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

 

(গ) নিউক্লিয়ার বিভাজন এবং পরিবেশ দূষণ :

নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরে ইউরেনিয়ামের দুটি সমস্থানিক ব্যবহার করা হয় :

(i) প্রাকৃতিক ইউরেনিয়াম অর্থাৎ ইউরেনিয়াম ২৩৫ (২৩৫U) (মূল মৌলের মাত্র ০.৭ শতাংশ)। এই সমস্থানিকটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিউক্লিয়ার বিভাজন প্রদর্শন করে এবং (ii) ইউরেনিয়াম ২৩৮ (২৩৮U) (মূল মৌলের ৯৯.৩ শতাংশ)। এই সমস্থানিকটি স্বতঃস্ফূর্ত নিউক্লিয়ার বিভাজন দেখায় না।  রিয়্যাক্টরে জ্বালানি দণ্ডের ইউরেনিয়াম ২৩৫ এর নিউক্লিয়াসের সঙ্গে নিউট্রনের সংঘাত ঘটিয়ে সমগ্র পদ্ধতিটির সূচনা করা হয়। ফলক্রমে ২৩৫ ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াস বিভাজিত হয়ে তেজষ্ক্রিয় বেরিয়াম (১৬ Ba), ক্রিপটন নিউক্লিয়াস

( Kr) এবং তিনটি নিউট্রন উৎপন্ন হয়। উদ্ভূত নিউট্রন পৃথক একটি ২৩৫ ইউরোনিয়াম নিউক্লিয়াসের বিভাজনে সাহায্য করে এবং শৃঙ্খল-বিক্রিয়ার (Chain reaction) সূচনা করে। প্রথম নিউক্লীয় বিভাজনে সৃষ্ট পৃথক একটি নিউট্রন ইউরোনিয়াম ২৩৮ নিউক্লিয়াসের দ্বারা শোষিত হয়, ফলে ইউরেনিয়াম ২৩৮ তেজষ্ক্রিয় সমস্থানিক ইউরেনিয়াম ২৩৯-এ পরিবর্তিত হয়। এই তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম ২৩৯ এর নিউক্লিয়াস বিটা-বিকিরণের মাধ্যমে নেপচুনিয়ামে’ পরিবর্তিত হয়। উৎপন্ন নেপচুনিয়াম পুনরায় একটি বিটা-রশ্মি বিকিরণ করে তেজষ্ক্রিয় প্লুটোনিয়ামে রূপান্তরিত হয়।

 

তেজস্ক্রিয় দূষণ | বিশ্বব্যাপী পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ | পরিবেশ অধ্যয়ন

 

 

সুতরাং, রিঅ্যাক্টনের জ্বালানি দণ্ডে ইউরেনিয়ামের পরিমাণ হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উপজাত হিসেবে অধিক বিভাজনক্ষম প্লুটোনিয়াম এবং বেরিয়াম পাওয়া যায়। প্লুটোনিয়াম ‘পারমাণবিক বোমা’ প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত হয়। বেরিয়ামের অর্ধায়ু কম হওয়ায় (মাত্র ১১ মিনিট) বিটাবিকিরণের মাধ্যমে ল্যান্থানিয়ামে পরিবর্তিত হয়।

ল্যান্থানিয়াম পুনরায় ‘বিটা’ বিকিরণের  ফলে পৃথক মৌলের নিউক্লিয়াসে পরিবর্তিত হয়। অর্থাৎ জ্বালানি দণ্ডের বেরিয়াম তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণের ফলে বহু অন্তর্বর্তী তেজস্ক্রিয় মৌলের মাধ্যমে অবশেষে দীর্ঘ-অর্ধায়ুযুক্ত পৃথক পৃথক তেজষ্ক্রিয় মৌলে পরিণত হয়। বেরিয়াম থেকে উৎপন্ন তেজস্ক্রিয় মৌলের অন্যতম হচ্ছে স্ট্রনসিয়াম ৯০ (৯০২৪Sr) (অর্ধায়ু-২৮ বছর) এবং সিজিয়াম ১৩৭ (১৩৭৫৫Cs) (অর্ধায়ু -৩০ বছর)।

তেজস্ক্রিয় দূষণ | বিশ্বব্যাপী পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ | পরিবেশ অধ্যয়ন

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment