আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় পরিবেশ ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ নীতি
পরিবেশ ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ নীতি
ব্যবস্থাপনা (Management) হলো সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া (Definite Process) । ব্যবস্থাপনা প্রধানত প্রধান চারটি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে। যথা- পরিকল্পনা (Planning ), সাংগঠনিক স্তর (Organizational level), নেতৃত্ব (Leadership) এবং নিয়ন্ত্রণ (Controlling) । ব্যবস্থাপনার এই চারটি স্তরই পরস্পর আন্তঃসম্পর্কিত। চিত্র- ১১.১ লক্ষ করুন। অপরদিকে পরিবেশ ব্যবস্থাপনা হলো পরিবেশ সুরক্ষায় পরিবেশগত সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া (Process) ।
চিত্র- ১১.১ ব্যবস্থাপনা
পরিবেশ ব্যবস্থাপনার প্রথম এবং প্রধান ধাপটি হলো পরিকল্পনা। পরিকল্পনা হলো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য যৌক্তিক উপায় বা সুচিন্তিত নির্দেশনা। পরিবেশ পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য হলো টেকসই উন্নয়ন (Sustainable Development) এর মাধ্যমে পরিবেশের সংরক্ষণ।
বিস্তারিতভাবে বলা যায় – প্রাকৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পরিবেশ এবং সর্বোপরি সুশাসনের বিষয়াদি বিবেচনা করে উন্নয়ন কার্যক্রমকে টেকসই করতে পরিবেশিক কার্যক্রমের সার্বিক কাঠামো নির্ধারণই হলো পরিবেশ ব্যবস্থাপনা।
পরিবেশ নীতি
পরিবেশ বিষয়ক সকল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণের জন্য নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বিধিবদ্ধভাবে যে সকল দিক-নির্দেশনা তৈরি করা হয় তাকে পরিবেশ নীতি বলে । বিজনেস ডিকশনারি (Business Dictionary) অনুযায়ী নীতি (Policy) হলো- এমন একটি মৌলিক নীতি যার দ্বারা একটি সরকার পরিচালিত হয় এবং ঘোষিত লক্ষ্য যা একটি সরকার বা দল অর্জন করতে চায়।
- Oiver M. Brandes and David B. Brooks – “Policy can be defined as a Course of action or principle adopted or proposed by a government party, business or individual.”অর্থাৎ, নীতি হলো কার্যের গতিপথ অথবা নির্দিষ্ট নীতি যা সরকার, দল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি নিজে প্রস্তাব করে বা অর্জন করে।
- John Mc Cormick 4 – “Environmental Policy refers to the commitment of an organization to the laws, regulations and other Policy mechanisms concerning environmental issues. “অর্থাৎ, পরিবেশগত ইস্যুগুলোর সাথে সম্পর্কিত আইন বিধি ও অন্যান্য নীতি প্রক্রিয়ার প্রতি কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানে প্রতিশ্রুতিই হলো পরিবেশ নীতি ।
পরিবেশ ব্যবস্থাপনা
পরিবেশ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশের মৌলিক ইস্যুজসমূহ অন্তর্ভুক্ত করে যা টেকসই অর্থনেতিক উন্নয়নের সাথে সম্পৃক্ত। পরিবেশ ব্যবস্থাপনার মূল উদ্দেশ্য উন্নয়ন কার্যক্রমকে এমনভাবে টেকসই করা যাতে পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করে পরিবেশকে বর্তমানে উপভোগ করা যায় এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও পরিবেশকে সংরক্ষণ করা যায় ।
পরিবেশ ব্যবস্থাপনার জন্য পরিবেশ নীতি তৈরি করা হয়। প্রতিবেশভিত্তিক ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য রক্ষা, পরিবেশগত দুর্যোগের হ্রাস এবং অর্থনৈতিক, প্রাকৃতিক এবং সামাজিক উন্নয়নের জন্য পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় কতিপয় নীতি অনুসরণ করা হয়, যেমন-
স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা রক্ষা নীতি (The Principle of Protection on health and Safely):
পরিবেশ ব্যবস্থাপনার জন্য পরিবেশগত নীতি প্রণয়নের সময় উদ্ভিদ, প্রাণী এবং জীবকূলের স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে। যেমন- কৃত্রিমভাবে তৈরি সাফারি পার্কে প্রাণীদের জন্য প্রাকৃতিক অভয়ারণ্য সৃষ্টি করা হয়েছে অপরদিকে মানুষের পরিদর্শনের জন্য নিরাপত্তা গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে করে প্রতিবেশভিত্তিক ভারসাম্য রক্ষা হচ্ছে। স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা রক্ষা নীতিতে অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত, স্থানীয় গোষ্ঠী, শিশু, নারী, বয়োবৃদ্ধ, পঙ্গু এবং পরিবেশগত বিপদ ব্যবস্থাপনাও গুরুত্ব দিতে হবে।
মাল্টি-সেক্টরাল সমন্বয় নীতি (The Principle of multi-Sectoral Integration) :
পরিবেশ ব্যবস্থাপনা হলো একটি সমন্বিত প্রক্রিয়া (Integrated Process ) । পরিবেশের সকল সেক্টরের মধ্যে সমন্বয় করে পরিবেশগত নীতি তৈরি করতে হবে কারণ পরিবেশ ব্যবস্থাপনার জন্য পরিবেশের পরিবেশগত সকল বিষয়সমূহ বিবেচনা করতে হবে। যেমন- জমিতে রাসায়নিক সার অধিক ব্যবহার করলে ফলন অধিক হবে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসবে কিন্তু পরিবেশগত ঝুঁকি হিসেবে মাটির উর্বরতা কমে যাবে। সেই ক্ষেত্রে জৈব সার ব্যবহারকে উৎসাহিত করতে হবে।
সাবধানতার নীতি (Precortionary Principle) :
পরিবেশগত বিষয়সমূহের ভারসাম্য রক্ষা করে। যে কোনো উন্নয়নের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। যেমন- পদ্মা ব্রিজের জন্য আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধির কারণে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসবে কিন্তু এই ব্রিজ পরিকল্পনার আগে নদীর নাব্যতা রক্ষা, নদীর স্রোত পরিবর্তন অর্থাৎ নদী সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে ব্রিজের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে।
অনিশ্চয়তা নীতি (Uncertainity Principles):
প্রাকৃতিক পরিবেশের ভিন্নতার ওপর নির্ভর করে সামাজিক পরিবেশের ভিন্নতা দেখা যায়। সামাজিক পরিবেশে ক্রমাগত পরিবর্তনের কারণে পরিবেশগত ব্যবস্থাপনায় পরিবেশগত নীতির বিভিন্ন বিষয়ের লক্ষ্য অর্জন অনিশ্চিতও হতে পারে।
আন্তঃউৎপাদনমূলক সমতা ( Inter- Generational Equality):
পরিকল্পনা এমনভাবে করতে হবে যাতে করে উৎপাদিত দ্রব্য সকলের অভাব পূরণ করে। বিশেষ গ্রুপ যেমন- শিশু, নারী, বয়স্ক গ্রুপ সকলে উপকৃত হয়। পরিকল্পনা কোনো এলাকার ওপর যেন কোনো নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে। যেমন- এমন কোনো পরিকল্পনা নেওয়া যাবে না যেখানে মরুময়তা বৃদ্ধি পেতে পারে। বনায়ন কর্তন করে নগর এলাকা বৃদ্ধি করে জীববৈচিত্র্য নষ্ট করা যাবে না ।
স্বীকৃতি ও বৈচিত্র্যতা সংরক্ষণ নীতি (Recognition and Preservation of diversity):
প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে আঞ্চলিক বিভিন্নতা তৈরি হয়। যেমন- নগরায়নের (Urbanization) কারণে ‘ক’ শ্রেণির কৃষি জমিকে স্বীকৃতি দিয়ে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে অর্থাৎ এই ক্ষেত্রে স্বল্প উৎপাদনক্ষম কৃষি জমিকে নগরায়নের জন্য নির্ধারণ করতে হবে। ইকোলজিক্যাল বৈচিত্র্যতার কথা চিন্তা করে ইকোপার্ক, ইকোটুরিজম বিভিন্ন এলাকা সংরক্ষণ করা যাবে।
দূষিতকরণ-নীতি (The Pollution Pays Principles):
পরিবেশ দূষণ রোধকল্পে পরিবেশনীতিতে জরিমানা প্রদানের সিস্টেম করে দূষণ রোধ করা যায়। যেমন- ইটের ভাটায় জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহার করলে জরিমানার ব্যবস্থা করে দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
প্রতিরোধ নীতি (Prevention Principles) :
পরিবেশগত প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করার চাইতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা হ্রাস করার জন্য বন সংরক্ষণ করা যেতে পারে। গাছ লাগানো বৃদ্ধি করা যেতে পারে। ওজোন স্তর সুরক্ষায় শিল্পকারখানার ইমিশন কমানো যেতে পারে। পানি দূষণ রোধ করার জন্য শিল্পকারখানার পানিকে শোধনাগারে শোধন করে পুনরায় ব্যবহার করা যেতে পারে।
সহায়কতার নীতি (The Principles of Subsidy ) :
পরিবেশবান্ধব প্রতিষ্ঠানকে প্রয়োজনে পরিবেশ নীতিতে সহায়তা (Subsidy) দেওয়া যেতে পারে ।
আরও দেখুন :